পূর্ব ঘোষণা মতোই আফগানিস্তান ছাড়ছে মার্কিন সেনা। অনুমান করা হচ্ছে, আগামী ৩১ আগষ্টের মধ্যে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারে। ইতিমধ্যেই, দেশটির রাজধানী কাবুলের উত্তরাঞ্চলের বারগাম বিমান ঘাঁটি থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র জোট ন্যাটো বাহিনীর সেনারা নিজ নিজ দেশের বিমান ধরেছে। ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনামের সায়গন থেকে যেভাবে মার্কিনীদের সরিয়ে ফেলা হয়েছিল, আফগানিস্তানে তেমনই দৃশ্যের অবতারণা হতে চলেছে। বস্তুত, আফগানিস্তানে এই শতকের শুরু থেকে আরম্ভ হওয়া মার্কিন আগ্রাসনের শেষাঙ্ক এমনতর হবে, এমনটা আশা করেননি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একটি বৃহৎ অংশ। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে টুইন টাওয়ারে বিমান হানায় আফগানিস্তানের তালিবান সরকারের সাথে জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার কথিত যোগ ঘোষণা করে মার্কিন প্রশাসন। শুরু হয় একবিংশ শতকের এক রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ের। বিগত, দুই দশকে গোটা বিশ্ব সাক্ষী থেকেছে ডেভিড বনাম গোয়ালিথের এই লড়াইয়ের। যার একদিকে আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত মার্কিন এবং ন্যাটো জোটের পথপ্রদর্শক বিদেশী মদতপুষ্ট আফগান সরকার এবং অন্যদিকে আধুনিক ও গেরিলা রণকৌশলের মিশেল তালিবান সেনা। আর তাতেই, টাল-মাটাল ‘ট্রিলিয়ান’ অর্থনীতির ফেরিওয়ালা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র এবং আফগানিস্তানের নানামুখী খাতে, মার্কিনীদের বিগত কুড়ি বছরে ব্যয় প্রায় ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। জনপ্রিয় মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, আফগানিস্তানে তালিবানদের ‘শাট ডাউন’ করতে মার্কিন খরচ ছাড়িয়ে গেছে বিল গেটস, জেফ বেজোস, ইলন মাস্কসহ বিশ্বের শীর্ষ ৩০ ধনকুবের মোট সম্পত্তির পরিমাণকেও। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পাঁচটি প্রতিরক্ষা ঠিকাদার সংস্থা যথাক্রমে- বোয়িং, রেথিয়ন, লকহিড মার্টিন, নরথর্প গ্রুমম্যান এবং জেনারেল ডায়নামিক্স, ২০০১ সালে তালিবানদের দমনে প্রতিরক্ষা সামগ্রী সরবরাহের বরাত লাভ করে ১০,০০০ (ভারতীয় মুদ্রায় যা ৭ লক্ষ টাকা) ডলারের স্টক ক্রয় করে। বর্তমানে যার মূল্য ১ লক্ষ কোটি ডলার যা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৭১ লক্ষ কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে যে, আফগানিস্তানে অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের মোট ২ দশমিক ২৬ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। অবাক করার মতো তথ্য হলো, শুধুমাত্র যুদ্ধের পেছনে ব্যয় হয়েছে ৮০০ বিলিয়ন ডলার ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে, আফগান সেনাদের প্রশিক্ষণে খরচ হয়েছে ৮৫ বিলিয়ন ডলার। আবার প্রতিবছর আফগান সেনাদের বেতন খাতে খরচ হয়েছে ৭৫০ মিলিয়ন ডলার। তাঁদের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০ বছর ধরে এই যুদ্ধটা চলেছে ধার করা অর্থে। ইতিমধ্যেই মার্কিনিরা ৫০০ বিলিয়ন ডলার সুদ পরিশোধ করতে বাধ্য হয়েছে। আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে এই সুদের পরিমাণ দাঁড়াবে ৬ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার। যার গানিতিক অর্থ, তালিবানদের ‘টাইট’ দিতে গিয়ে আগামীতে প্রত্যেক মার্কিন নাগরিকের ঘাড়ে ২০ হাজার ডলার ঋণের বোঝা চাপতে চলেছে।
খরচের বহর দেখলেন। আসুন, এবার এই লড়াইয়ের ক্ষয়-ক্ষতির বহরে নজর দেওয়া যাক:
দুই দশকের এই লড়াইয়ে, এখনো পর্যন্ত প্রায় ৩০০০ মার্কিন সেনা প্রাণ হারিয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে দেশটিতে নিহত হয়েছেন প্রায় চার হাজার মার্কিন নাগরিক। অন্যদিকে, ২০০১ সাল থেকে চলা এই যুদ্ধে ইতিমধ্যেই ৬৯ হাজার আফগান সেনাসদস্য এবং ৪৭ হাজার বেসামরিক আফগান জনগণের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও, ভিন্নধর্মী নানা সংঘাতে দেশটিতে ৫১ হাজার সদস্য নিহত হয়েছেন।
এ গেল শুধু নিহতের হিসাব। আফগান যুদ্ধের ফসল আরও ২০ হাজার আহত মার্কিন সেনা। এই লড়াইয়ে বেসামরিক জনগণের সাহায্যে নিয়োজিত বিভিন্ন দাতা সংস্থার প্রায় ৫০০ স্বেচ্ছাসেবক নিহত হয়েছেন। এছাড়াও, বিগত কুড়ি বছরে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের প্রায় ৮০ জন সাংবাদিক এই যুদ্ধে অকালে প্রয়াত হয়েছেন।
পপি(আফিম) অর্থনীতির সোনার ডিম আফগানিস্তান। এছাড়াও, পুরো আফগানিস্তান জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে হাজারো খনিজ সম্পদ। ফলে, যুগ যুগ ধরে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নেক নজরে রয়েছে এই দেশ। কিন্তু, অদ্ভুতভাবে বিদেশী মদতপুষ্ট আফগান সরকার কখনোই সিংহভাগ আফগানিস্তানে মুখ হতে পারেনি। একদা, কাবুলের শাসক শাহ সুজাকে সামনে রেখে, ব্রিটিশ রাজ ১৮৪২ সালে আফগানিস্তান দখলের চেষ্টা করে। কিন্তু, কাবুল অধিপতি দোস্ত মহম্মদ খানের কাছে নাকানিচুবানি খায় ব্রিটিশরা। পরবর্তীতে রাশিয়া বাবরাক কার্মাল এবং নাজিমুল্লা আহমেদজাই সামনে রেখে, আফগানিস্তানের রাশ নিজ হাতে রাখতে সচেষ্ট হয়। কিন্তু, এক্ষেত্রে ও আফগানী ‘জাজবা’ অটুট থাকে। এবারেও, আশরাফ গনিকে পুতুল সরকার বানিয়ে মার্কিনীদের হিন্দুকুশ বিজয় অধরাই থাকলো।