অনল আবেদিন
টানা এক মাস ধরে প্রবল টানাপোড়েন চলল। সেই টানাপোড়েন সদ্যজাত মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ভাষা ও সাহিত্য পড়ানো হবে কি না, তাই নিয়ে। পড়ুয়া ও অধ্যাপকদের একাংশ এবং জঙ্গিপুরের সাংসদের সঙ্গে উপাচার্য ও উচ্চশিক্ষা মন্ত্রীর এই টানাপোড়েন। অবশেষে, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি পঠনপাঠনের সরকারি অনুমতি মিলেছে গত ১৩ আগস্ট। ওই দিন সেই টানাপোড়েনে ‘কমা’ পড়লেও ‘পূর্ণচ্ছেদ’ এখনও পড়েনি। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, নাকি জেলার অন্য কোথাও অস্থায়ী ক্যাম্পাসে আরবি বিভাগ চালু করা হবে, এখন তা নিয়ে চলছে দড়ি টানাটানি। লেবু কচলিয়ে তেতো করার মতো এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি নিছকই তৈরি করা। এর প্রয়োজন ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আন্তর্জাতিক ভাষা শিক্ষাকে ইচ্ছাকৃতভাবে সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে পরিণত করা হয়েছে। সেই বিষয়টি বুঝতে আমাদের যেতে হবে ১৭৭ বছর পিছনে।
অষ্টাদশ শতকে বিশ্বজুড়ে মুর্শিদাবাদ জেলার পরিচিত ঘটত বহরমপুর শহরের কাশিমবাজারের সমৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কারণে। সেই কাশিমবাজারের রাজা কৃষ্ণনাথ ১৮৪৪ সালের ৩১ অক্টোবর আত্মঘাতী হন। তার আগের দিন ২১ বছরের তরুণ রাজা উইল করে তাঁর রাজ্যপাটের সবটা বিলিবণ্টন করেন। তাঁর স্ত্রী, ১৭ বছরের কিশোরী স্বর্ণময়ী তখন অন্তঃসত্ত্বা। উইলে তাঁর স্ত্রী, মা ও আরও কয়েক জনের খোরপোষের ব্যবস্থা করেন। বাকি রাজ্যপাট নিজের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার জন্য দান করেন। উইলে লেখেন, “সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হবে ‘দ্যা কৃষ্ণনাথ ইউনিভার্সিটি অব বানজেটিয়া’। বহরমপুর শহর লাগোয়া বানজেটিয়া এলাকার সেই প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমও তিনি উইলে লিপিবদ্ধ করেন। উইলে লেখেন, “ইংলিশ, ল্যাটিন, ফ্রেঞ্চ, সংস্কৃত, বাংলা, ফারসি এবং আরবি ভাষা এবং বিজ্ঞান শেখাতে হবে।” স্বর্ণময়ী পুত্র সন্তান প্রসব না করলে ওই সম্পত্তি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার কথা লেখা ছিল উইলে। রানি পুত্র সন্তান প্রসব করেননি। তাঁর মৃত্যুর পর উইল কার্যকর করার ভার কৃষ্ণনাথ দিয়েছিলেন ব্রিটিশরাজকে।
রাজার মৃত্যু পর রাজ্যপাটের মালিকানা নিয়ে রানি স্বর্ণময়ীর সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের ও তাঁর শাশুড়ির মামলা বাধে। মামলা গড়ায় সুপ্রিমকোর্ট পর্যন্ত। অবশেষে তিনটি মামলাতেই স্বর্ণময়ীই জেতেন। কিন্তু কৃষ্ণনাথের মৃত্যুর পৌনে দুশো বছর পরেও মুর্শিদাবাদ জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ১৮৫৩ সালে বহরমপুরে জন্ম নেয় ‘বহরমপুর কলেজ’। ১৯০৩ সালে সেই কলেজের নামকরণ হয় ‘কৃষ্ণনাথ কলেজ’। সেই কলেজ ভবনে বিশ্ববিদ্যালয় গড়া হবে বলে সরকারি নির্দেশনামা জারির সঙ্গেই ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে বিধানসভার অধিবেশনের শেষ দিনে ‘দ্যা মুর্শিদাবাদ ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট’ পাস হয়। ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করা হয় কৃষ্ণনাথ কলেজের অধ্যক্ষ সুজাতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাগচিকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর স্তরে ১৪টি বিষয় পড়ানোর জন্য উচ্চশিক্ষা দফতরের অনুমোদন চেয়ে উপাচার্য রিকিউজিশন পাঠান। গত ১৪ জুলাই সেই রিকিউজিশন মঞ্জুর হয়। ওই ১৪টি বিষয়ের মধ্যে বাংলা, ইংরাজি ও সংস্কৃত থাকলেও নেই আরবি। অথচ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশে কলেজের এই ভবনেই ১৮৬৪ সালে একই সঙ্গে সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি ভাষার পঠনপাঠন শুরু হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের ফলে মুর্শিদাবাদ জেলার মুসলিমদের উচ্চবিত্ত ও উচ্চশিক্ষিত অংশটি পূর্বপাকিস্তানে চলে যায়। সম্ভবত এই কারণে এই কলেজে আরবি পঠনপাঠন বন্ধ হয়ে যায়।
মু্র্শিদবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪টি বিষয়ের তালিকায় আরবি না থাকলেও উপাচার্যের আবেদন ক্রমে বাংলা ও ইংরেজিকে ছাড়িয়ে গিয়েছে সংস্কৃত। সর্বোচ্চ আসান বরাদ্দ হয়েছে সংস্কৃতের জন্য। ৮০টি। মাতৃভাষা বাংলার জন্য ৬০টি ও আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরাজির জন্য ৪০টি আসন বরাদ্দ করা হয়। আরবি ভাষা ও সাহিত্যের অনুরাগীরা এবার আন্দোলনে নামেন। উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী ব্রাত্য বসু ও উপাচার্য সুজাতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাগচির হাতে তুলে দেন স্মারকলিপি। এই আন্দোলনের অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান অধ্যাপক বদিউর রহমান, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সাইদুর রহমান, গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান অধ্যাপক মেহেদি হাসান ও মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন কলেজের আরবি বিভাগের অধ্যাপকদের একটি অংশ। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের প্রাক্তনী, ‘পশ্চিমবঙ্গ ভাষা রক্ষা কমিটি’, ছাত্র সংগঠন এসআইও, মাদ্রাসা ফোরাম ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে জঙ্গিপুরের সাংসদ খলিলুর রহমানও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ইস্যু হয়ে উঠে এই আন্দোলন।
নবগঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পরিকাঠামোর অভাবের কথা বলে আরবি চালু করতে না চাওয়ার বিষয়ে গোঁ ধরে বসেন। একটি সমৃদ্ধশালী, আন্তর্জাতিক ও ঐতিহ্যশালী ভাষা হিসাবে না দেখে উপাচার্য আরবি ভাষা ও সাহিত্যকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে শুরু করেন। তাঁর সাফ কথা, সরকারের সংখ্যালঘু দফতর, অথবা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনও ধনী ব্যক্তি, বা সংস্থা পরিকাঠামো গড়ে না দিলে তিনি আরবি চালু করবেন না। গত ১৪ জুলাই অনুমোদন পাওয়া সংস্কৃত- সহ ১৪টি বিষয়ের বেলায় তিনি এই রকম কোনও সর্ত আরোপ করেননি। অথচ এই জেলার ১৫টি কলেজে স্নাতকস্তরে আরবি পাঠ্য রয়েছে। তার মধ্যে ৮টি কলেজে আরবিতে অনার্স রয়েছে। সুজাতাদেবী এক সময় লালগোলা কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। সেই সময়ে ওই কলেজে আরবি পঠনপাঠন চালু ছিল। সেই কলেজ থেকেই তিনি কৃষ্ণনাথ কলেজে এসেছেন। প্রথমে অধ্যক্ষ ও পরে উপাচার্য হন। তারপরেও তিনি ১৪টি বিষয়ের রিকিউজিশন চেয়ে উচ্চশিক্ষা দফতরে আবেদন করার সময় এ জেলার স্নাতকস্তরের আরবির পড়ুয়াদের উচ্চশিক্ষার সুযোগের কথা ভুলে গেলেন কী করে? এটা কী ভাবে সম্ভব? এমন একটা প্রশ্ন জনমানসে আলোড়িত হতে থাকে।
উচমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভানেত্রী মহুয়া দাস যে মনোভঙ্গি থেকে এ বারের উচ্চমাধ্যমিকের প্রথম স্থানাধিকারী রুমানা সুলতানার নামের বদলে তাঁর ধর্মীয় পরিচয় তুলে ধরেন, সেই একই মনোভঙ্গির কারণেই কী মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি চালু করার বিষয়ে উপাচার্য সুজাতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাগচির মনে বার বার ঘুরে ফিরে আসছে সংখ্যালঘু দফতর ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধনী ব্যক্তির প্রসঙ্গ? ২৮টি রাষ্ট্রের সরকারি ভাষা ও সরকারি কাজের জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘ স্বীকৃত ৬টি ভাষার মধ্যে আরবি অন্যতম একটি। অষ্টম শতাব্দী থেকে শুরু করে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত কালপর্বে বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞান, দর্শন, গণিত ও চিকিৎসা শাস্ত্র- সহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা দিকের অমূল্য সম্পদে সমৃদ্ধ আরবি ভাষাকে উপাচার্য কী করে বিশেষ একটি ধর্ম সম্প্রদায়ের বেড়ায় আবদ্ধ করেন?
শিক্ষা, রুচি, অভ্যাস ও স্বভাবগত কারণে কেউ তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিগত পরিসরে, অথবা পারিবারিক পরিধির আচরণে সাম্প্রদায়িকতাকে লালন পালন করবেন? নাকি অসাম্প্রদায়িকতা-ধর্মনিরপেক্ষতায় সমৃদ্ধ হবেন? সেটা তাঁর একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকারি কর্মকাণ্ডে সাম্প্রদায়িক মানসিকতার প্রতিফলন ও আচরণ অবশ্যই ঘৃণ্য ও প্রতিবাদ যোগ্য। শিক্ষা আনে চেতনা। আর সেই চেতনাই নাকি কুপমণ্ডুকতায় বিপ্লব আনে। কিন্তু নবগঠিত মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটছে উলোটপুরাণ। বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠেছে, উপাচার্য এই নবগঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভিত’ গাঁথলেন সাম্প্রদায়িকতার বিষে জারিত ককটেল দিয়ে। তিনি বলেছেন, আরবি পড়াতে হলে সংখ্যালঘু দফতরকে পরিকাঠামো তৈরি করে দিতে হবে। এও সেই হৃদকন্দরের গোপন মাঝারে সযত্নে লুকিয়ে রাখা সুপ্ত সাম্প্রদায়িক মানসিকতা থেকে রুমানা সুলতানার নামের বদলে তাঁর ধর্ম সম্প্রদায়ের নামের উল্লেখ করার মতোই বিদ্বেষ বিষজাত নয় কি?
(ক্রমশ)