অনল আবেদিন
(শেষাংশ)
পণ্ডিতদের মতে ইউরোপে রেনেসাঁসের আগমনের পূর্বশর্ত ছিল লাতিন ও গ্রিক ভাষার উত্তরসুরি আরবি ভাষার মাধ্যমে জ্ঞানচর্চা। পুজোর মন্ত্র পড়া হয় বলে, বেদ উপনিষদ ও গীতার মতো দার্শনিক গ্রন্থ লিখিত হয়েছে বলে সংস্কৃত ভাষা হয়ে যাবে হিন্দুর ভাষা? আর পবিত্র কোরান শরিফ লেখা হয়েছে বলে, নামাজ পড়া ও আজান দেওয়া হয় বলে আরবি হয়ে যাবে মুসলমানের ভাষা? কোনও অসাম্প্রদায়িক মনন কোনও ভাষার গায়ে কখনও সাম্প্রদায়িক স্ট্যাম্প মেরে দেয় না। এ রকম আবোলতাবোল পদ্ধতিতে সুস্থ মানুষ ভাবে না। স্থান-কাল-পাত্রের কারণে কোনও ভাষা আঁকড়ে কোনও ধর্মের উদ্ভব ও বিস্তার ঘটে। তবুও কোনও ভাষার গায়ে কোনও ধরণের সাম্প্রদায়িকতা দেগে দেওয়া পাপ। মহাপাপ। এ সব গভীর জ্ঞানের কথা এখন থাক। মামুলি হিসাবেই বিশ্লেষণ করা যাক আরবি নিয়ে উপাচার্যের আচরণের ন্যায্যতার বিষয়টি। মুর্শিদাবাদ জেলায় ১৫টি কলেজে আরবি ভাষা ও সাহিত্য পড়ানো হয়। তেমন একটি কলেজ রয়েছে লালগোলায়। লালগোলা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সোমনাথ চক্রবর্তী বলেন, “মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রতি বছর আরবিতে প্রায় ৪৫০ জন ছাত্রছাত্রী স্নাতক হয়। আর্থিক কারণে ও আসন সংখ্যার অপ্রতুলতার কারণে তাদের মধ্যে অধিকাংশ জনই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি নিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না।”
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবিতে এমএ পড়ানোর ব্যবস্থা করার জন্য বছর ছয়েক আগে চেষ্টা করেছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। সফল হননি। তার পর চালু হল মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়। এ জেলায় রয়েছে মোট ২টি ল’ কলেজ। সদ্যগঠিত মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগ- সহ ১৪টি বিষয় চালু করতে উপাচার্য কথিত কোনও ‘পরিকাঠামো’র অভাব হয়নি, আবেদন নিবেদনেরও প্রয়োজন পড়েনি, আন্দোলনও করতে হয়নি। অন্যদিকে আরবি পড়ানোর বিষয়ে অনেক ব্যক্তি, সংস্থা, সাংসদ ও সংগঠনের আবেদন নিবেদন সত্ত্বেও ১৫টি কলেজে আরবি পড়ানো জেলার একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কণ্ঠে শোনা যায় ‘পরিকাঠামো’র অভাব ও সংখ্যালঘু দফতরের কথা। সোমনাথ চক্রবর্তীর আক্ষেপ, “আরবির সুবাদে বিদেশের বাজারের চাকরির বেশ সুযোগ রয়েছে মুর্শিদাবাদ জেলার বেকারদের। তাই আরবির মতো প্রাচীন ও সমৃদ্ধশালী ভাষা মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠনপাঠনের ব্যবস্থা না-থাকাটা খুবই দুঃখের ও বঞ্চনার।”
উল্লেখ্য, মাদ্রাসায় খোঁজ নিলে দেখা যাবে, একমাত্র সংখ্যালঘুরাই আরবি পড়ে না। সংখ্যাগুরুদেরও অনেকেই আরবি পড়েন। একটি নিবন্ধে হাইস্কুল শিক্ষক মুহাম্মদ আবু সাঈদ লিখেছেন, “২০২১ সালে হাইমাদ্রাসার ৩২১৫ জন অমুসলিম ছাত্রছাত্রী মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। গত বছরে রাজ্যের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১২ শতাংশ ছিল অমুসলিম। রাজ্যে অন্তত ১০টি হাইমাদ্রাসায় ৪০ শতাংশেরও বেশি অমুসলিম ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া করে।” এই বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় দিয়েছিল মুর্শিদাবাদ জেলার নাইত সামসেরিয়া হাইমাদ্রাসার ৮২ জন ছাত্রীছাত্রী। তার মধ্যে ৫০ জনই সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের। অর্থাৎ প্রায় ৬১ শতাংশ। এমন দৃষ্টান্ত অনেক আছে। আরবি ভাষায় দারুণ দক্ষতা না থাকলে ভাই গিরীশচন্দ্র সেন পবিত্র কুরান শরিফ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করতে পারতেন না। এমন একটি ভাষা বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করার বিষয়ে সংখ্যালঘু দফতরকে, অথবা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধনী ব্যক্তি, বা সংস্থাকে পরিকাঠামো’ গড়ে দেওয়ার দাবির মধ্যে স্বাভাবিকতা নেই। এ জেলার অধিবাসীদের মধ্যে প্রায় ৬৭ শতাংশ মুসলিম। উপাচার্যের যুক্তি, এ কারণে আরবি চালু করতে হলে সংখ্যলঘু দফতরকে পরিকাঠামো গড়ে দিতে হবে। বিতর্ক না করে উপাচার্যের কথা মেনে নিলে, উচ্চশিক্ষা দফতরের অনুমোদনের জন্য ১৪টি বিষয়ের রিকিউজিশন পাঠানোর সময় আরবির কথাটিই তিনি প্রথমেই মাথায় রাখতেন। তার বদলে মাথা থেকেই উধাও।
মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার সুবাদে রাজা রামমোহন রায়ের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘তুহ্ফাৎ-উল-মুহাহ্-হিদিন’ এর বিষয়টি জানা থাকার কথা। আরব থেকে আগত অনেক জ্ঞানীগুণীর সঙ্গে জ্ঞানের আদান প্রদান হত রাজা রামমোহন রায়ের। রামমোহন তখন কাশিমবাজারে ইংরেজদের কুঠির কর্মচারী, মতান্তরে লালবাগে নবাবি সেরেস্তার। আজ থেকে প্রায় ২১৮ বছর আগে ১৮০৩ সালে একেশ্বরবাদ নিয়ে ফার্সিতে লেখা ওই গ্রন্থটির ভূমিকা রামমোহন নিজে লিখেছিলেন আরবিতে। গ্রন্থটির নামও আরবি ভাষায়। এই সমৃদ্ধ ভাষা শিখতে ‘ভারতপথিক’ রামমোহন পাড়ি দিয়েছিলেন পাটনায়। ‘ভারতত্ত্ব’-এর লেখক আল বিরুনি সর্বকালের বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম একজন। একাদশ শতকের এই মনীষীর মাতৃভাষা ফারসি। তিনি কিন্তু তাঁর শতাধিক গ্রন্থ মাতৃভাষা ফারসিতে লিখেননি। ভাষা-মাধুর্যের গুণে তিনি লিখেছেন সমৃদ্ধ আরবি ভাষায়। বেশ কয়েক বছর আগে এ জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে বহরমপুর রবীন্দ্রসদনে একটি নাগরিক কনভেনশন হয়েছিল। সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের অগ্রপথিক রেজাউল করিমের ভ্রাতুষ্পুত্র, তথা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবুল হাসনাত সেই কনভেনশনে বলেছিলেন, “মুর্শিদাবাদ একদা অবিভক্ত বাংলা-বিহার-ওড়িষ্যার রাজধানী ছিল। তাই এখানে গবেষণার প্রচুর সম্ভবনা আছে।” ওই সব গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার সুযোগ করে দেওয়ার জন্যও এ জেলার বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ও ঊর্দু পাঠ্য হওয়া আবশ্যিক।
২১ বছরের তরুণ রাজা কৃষ্ণনাথ মুর্শিদাবাদ জেলায় বিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। ১৮৪৪ সালের সেই স্বপ্ন ১৭৭ বছরের ব্রিটিশ রাজত্বে, পরে প্রায় ৩০ বছরের কংগ্রেস রাজত্বে এবং তারও পরে ৩৪ বছরের বামজমানায় পূরণ হয়নি। এখন তৃণমূল কংগ্রেসের জমানায় সেই স্বপ্নপূরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একে স্বাগত জানাতে হবে। কিন্তু এর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে আরও একটি অতি জরুরি বিষয়। যে কোনও সরকারের পলিসির চরিত্র ও রূপায়ণের সাফল্য নির্ভর করে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আধিকারিকদের মনোভঙ্গি ও কর্মকুশলতার উপর। যে কোনও সরকারের ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতান্ত্রিকতাও নির্ভরশীল মাসিক লাখ লাখ টাকা বেতনভুকদের মানসিক গঠন ও কর্ম সম্পাদনের প্রকৃতির উপর। আরবি চালুর বিষয়ে ‘পরিকাঠামো’র ইস্যু তাই জনমানসে সরকারের স্বচ্ছ ও সুন্দর ভাবমূর্তি তুলে ধরেনি।
সহজ পথের বদলে উল্টো পথে হাঁটলে উচ্চ মাধ্যমিক সংসদ সভানেত্রী মহুয়াদেবী ও উপাচার্য সুজাতাদেবীকে তখন পৃথক দাঁড়ি-পাল্লায় মাপা যাবে না । সরকারি কর্মকাণ্ড থেকে সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতার চাদর সরিয়ে না নিলে, দীর্ঘ মেয়াদি প্রকল্পে মোদী-শাহ-যোগীদের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বিষের মারণ ককটেলকেই উপাদেয় করে গড়ে তোলা হবে। সে কথা সম্ভবত অনুধাবন করে গত ১৩ অগস্ট উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতির পদ থেকে মহুয়া দাসকে অপসারণ করা হয়েছে। ওই দিনই মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ চালু করার অনুমতি দিয়ে ৮০টি আসন বরাদ্দ করেন উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী ব্রাত্য বসু। কিন্তু কোথায় হবে আরবি বিভাগ? ১৮৬৪ সালের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের বহরমপুরের মেইন ক্যাম্পাসে আরবি বিভাগ চালু করার বিষয়ে দ্রুত ‘ছুৎমার্গ’ ত্যাগ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এই আন্দোলনের অন্যতম নেতা অধ্যাপক সাইদুর রহমান লালগোলা কলেজের আরবি বিভাগের প্রধান। তিনি বলেন, “বহরমপুরে মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই আরবি বিভাগ চালু করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আরবি বিভাগের নিজস্ব ঘর তৈরি না হওয়া পর্যন্ত প্রয়োজন হলে বিশ্বভারতীর মতো ক্লাস হবে প্রাঙ্গণের গাছতলায়। এটা আমরা উপাচার্যকে জানিয়ে দিয়েছি।” তাই, দ্রুত এই টাগ অফ ওয়ার বন্ধ হোক।