দেশভক্তি ও রবীন্দ্রনাথ

Must read

আবু সিদ্দিক

হিন্দু জাতীয়তাবাদ তো দূরে থাক, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথ বিশেষ উৎসাহী ছিলেন না। শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে, গাইয়ে বা তাঁর কবিতার বুলি আউড়ে সভা সমিতিতে হাততালি কুড়িয়ে গদগদ গর্বিত বাঙালির সাময়িক মুখোশ পরে রবীন্দ্রনাথকে সম্পূর্ণরুপে ধরা যায় কি? আমরা রবীন্দ্রনাথকে যতটা দূরে ফেলতে পেরেছি ততটাই, ঠিক ততটাই আমরা রাবীন্দ্রিক হয়ে উঠতে পেরেছি। এ গর্ব বড় বিষাদের নয় নিশ্চয়! তাঁকে উপলব্ধি করে জীবন অতিবাহিত করা তো অনেক বড় কথা। মহাপুরুষ হলে সেটি অসম্ভব নয়। কিন্তু আমরা ছাপোষা মানুষ। বইয়ের তাকে তাঁর এক চিলতে উপস্থিতিই আমাদের পরম পরিতৃপ্তি। তাই সমরবাবুর অকপট কথা আমাদের হৃদয়ের বন্ধ দরজায় আঘাত হানে না। ‘Not that the very young people care or have the time or money to go through all his works Rabindrasangeet is enough for them, and there is so much of it these days that one gets tired and smells something behind the propagation of Tagore culture through music.’[1]  তাই ‘আজি বসন্ত এসে গেছে’র সাথে সাথে হু হু করে আসছে অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিষ বাতাস। চাই নির্মল শ্রাবণ ধারা। আর তা সম্ভব রবীন্দ্রনাথকে পাথেয় করেই।

গান ও কবিতার বাইরে আরও অনেক অচেনা বা কিছু চেনা রবীন্দ্রনাথ আছে। ভাবাবেগে তাড়িত না হয়ে নির্মোহ হয়ে ভাবলে বুক চিতিয়ে বলতে পারি তিনি ছিলেন কর্মযোগী এক অন্তহীন সমুদ্র। আধুনিক ভারতের রুপকারদের মধ্যে তিনি অন্যতম। বিশ্বকবির সাথে সাথে তিনি ছিলেন বিশ্ব মানুষ। এক উজ্জ্বল মুক্ত পথের পথিক, সব ধরনের সংকীর্ণতার উর্দ্ধে। আজকের ভয়াবহ ভারতে তাঁকে নিয়ে আলোচনা খুবই প্রাসঙ্গিক। আশা এই যদি ঘন অন্ধকারে আবছা আলো আসে মন্দ কী!

রবীন্দ্রনাথ দেশভক্ত ছিলেন কিন্তু অন্ধভক্ত ছিলেন না-সঠিকভাবে  বললে  তিনি ন্যায় ভক্ত ছিলেন। অন্যায়ের, অবিচারের বিরুদ্ধে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বেশিরভাগ তুলতুলে আধুনিক বুদ্ধিজীবীদের ন্যায় মৌন ছিলেন না। তিনি মানবতার পক্ষে ছিলেন।

Tagore’s criticism of patriotism is a persistent theme in his writings. As early as 1908, he put his position succinctly in a letter replying to the criticism of Abala Bose, the wife of a great Indian scientist, Jagadish Chandra Bose: ‘Patriotism cannot be our final spiritual shelter; my refuge is humanity. I will not buy glass for the price of diamonds, and I will never allow patriotism to triumph over humanity as long as I live.’[2]

দেশভক্তি বলতে আসলে রবীন্দ্রনাথ কী বুঝাতে চেয়েছেন তা খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে তার ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে। নিখিল সমাজ সংস্কারে ব্রতী। সে মহিলাদের মুক্তির জন্য নানাবিধ কাজ করেন। কিন্তু সে ইংরেজ বিরোধী কাজে অত উৎসাহ পায় না যতটা সে নিজের সমাজের বিনির্মাণ ও পুনর্নির্মাণে পান। স্বাভাবিক কারণে দিনে দিনে তার উগ্র জাতীয়তাবাদী বউ বিমলার কাছে নিখিলের সম্মান ও আকর্ষণ  কমতে থাকে। এবং বিমলা তার স্বামীর বন্ধু বাগ্মী উগ্র জাতীয়তাবাদী সন্দীপের প্রতি আকর্ষণ গভীর হতে থাকে এবং ভালবাসার বন্ধনে তারা দুজনে জড়িয়ে পড়ে। যাই হোক নিখিল তার সিদ্ধান্তে স্থির থাকে। তাকে আমরা বলতে শুনি, ‘আমি দেশের সেবা করতে রাজি, কিন্তু আমি সবসময় সত্য ও ন্যায়ের পূজারি, যা আমার দেশের থেকেও বড়। দেশকে ঈশ্বর হিসাবে পূজা করার অর্থ হল দেশের সর্বনাশ করা।’

ভারতের অতীত গৌরব সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথ খুব একটা উৎসাহী ছিলেন না। ‘He condemned  romantic overattachment to the past, what he called the tying of India to the past ‘like a sacrificial goat tethered to a post’, and he accused men who displayed it—they seemed to him reactionary of not knowing what true political freedom was, pointing out that it is from the English thinkers and English books that the very notion of political liberty was derived.’ (qtd. in Argumentative Indian, p. 105). তিনি তাঁর Nationalism গ্রন্থেও ঐ একই কথা আরও জোর দিয়ে বলেছেন। দেশের পূজা নয়, সত্যের ও ন্যায়ের পূজায় তাঁর কাছে মুখ্য।

India has never had a real sense of nationalism. Even though from childhood I had been taught that idolatry of the Nation is almost better than reverence for God and humanity, I believe I have outgrown that teaching, and it is my conviction that my countrymen will truly gain their India by fighting against the education which teaches them that a country is greater than the ideals of humanity.[3]

ভারতের বৈচিত্র্য তাঁকে মুগ্ধ করেছে। ভারতের ইতিহাস কোন একটি নির্দিষ্ট জাতীর ইতিহাস নয়। আজকের মুক্তবাজার, বিশ্বায়ন, রবোটিক বিজ্ঞান, অসম প্রতিযোগিতা নিশ্চয় রবীন্দ্রনাথকে ব্যাথা দিত। এর আভাস আমরা নিম্নলিখিত কথাতে পাই। What is more, we have to recognize that the history of India does not belong to one particular race but to a process of creation to which various races of the world contributed—the Dravidians and the Aryans, the ancient Greeks and the Persians, the Mohammedans of the West and those of central Asia. Now at last has come the turn of the English…and we neither have the right nor the power to exclude this people from the building of the destiny of India. Therefore what I say about the Nation has more to do with the history of Man than specially that of India. The history has come to a stage when the moral man, the complete man, is more and more giving way, almost without knowing it, to make room for the political and the commercial man, the man of the limited purpose. The process, aided by the wonderful progress of science, is assuming gigantic proportion and power, causing the upset of Man’s moral balance, obscuring his human side under the shadow of soulless organization. We have felt its iron grip at the root of our life, and for the sake of humanity we must stand up and give warning to all, this nationalism is a cruel epidemic of evil that is sweeping over the human world of the present age, and eating into its moral vitality (Nationalism, pp.58-59)

উদাহরণ স্বরূপ তিনি জাপানের দিকে ইঙ্গিত করেন। মূল্যবোধ, স্বাধীনতা, নৈতিকতা কিভাবে মানুষ হাসতে হাসতে বিসর্জন দিতে বাধ্য হচ্ছেন সরকারী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে। এখানে মানুষ আর রক্ত মাংসের মানুষ নয়, সে শুধুমাত্র উৎপাদক সহায়ক এক বৈচিত্র্যহীন যন্ত্র হিসাবে জাতির গর্ব।

I have seen in Japan the voluntary submission of the whole people to the trimming of their minds and clipping of their freedom by their government, which through educational agencies regulates their thoughts, manufactures their feelings, becomes suspiciously watchful when they show signs of inclining toward the spiritual, leading them through a narrow path not toward what is true but what is necessary for the complete welding of them into one uniform mass according to its own recipe. The people accept this all-pervading mental slavery with cheerfulness and pride… (Nationalism, 68)

তাঁহার স্বদেশ-প্রেম ও হিন্দুত্বের মধ্যে কোনো সঙ্কীর্ণতা ছিল না(‘ও আমার দেশের মাটি তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা,/ তোমাতে বিশ্বময়ীর তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।’)। এই দিক হইতেই  তাঁহার সহিত তাঁহার যুগের বাঙালীর মিল ছিল না, আরও বলিব, আজিকার বাঙালীর সঙ্গেও নাই; কারণ এই—সাধারণ বাঙালীর, তা সেকালেরই হউক বা একালের হউক, দেশপ্রেম যত না দেশের প্রতি ভালবাসা তার চেয়ে অনেক বেশি ইংরেজ বিদ্বেষ; আর হিন্দুত্ব যত না উহার প্রতি শ্রদ্ধা তার চেয়ে অনেক বেশি মুসলমান বিদ্বেষ; কোনো দিকে যাহাকে ভালবাসা বলা যায় তাহার ভাগ যতটুকু স্বদেশ বা হিন্দুত্ব পাইত বা পায়, তাহা অজ্ঞতার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, সুতরাং উহা হইত মিথ্যা বড়াই।[4]

বার্ধক্যের স্মৃতিচারণে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেনঃ ‘কবে যে গান গাহিতে পারিতাম না তাহা মনে পড়ে না।’  একটু ঘুরিয়ে এ-কথাটিই তিনি তার স্বদেশানুভূতি বিষয়ে বলতে পারতেন-‘কবে যে দেশকে জানিতাম না তাহা মনে পড়ে না’, কারণ বুদ্ধি ও জ্ঞান-বাহিত  উপলব্ধির বহু পূর্বেই তিনি আনন্দানুভূতির সুত্রে দেশকে বোধের মধ্যে অনুভব করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তার শৈশব-বাল্য-কৈশোরের সবটুকুই কেটেছিল স্বদেশপ্রেম মাতাল পারিবারিক আবহাওয়ায়। ‘জাতীয় মেলা’ বা ‘হিন্দু মেলা’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঠাকুরবাড়িরই আনুকুল্যে ১৮৬৬ সালে; রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন পাঁচ এবং আট বৎসর পরর তেরো-পেরুনো সদ্য কিশোর তিনি পাঠ করেছিলেন তার প্রথম মুদ্রিত কবিতা- ‘হিন্দুমেলার উপহার’। দৈশহিতৈষণার এই ভাবতরঙ্গ উদীয়মান তরুণ কবিকে উদ্দীপিত করেছিল অবশ্যই , কিন্তু বাৎসরিক ঐ মেলা যথোচিতকালে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করলে তিনি দুঃখিত হননি। কারণ ২০/২২ বছর বয়সে পৌঁছুতে-পৌঁছুতে তিনি জেনেছিলেন, ‘জাতীয় মেলা’ যত আদর্শিকই হোক না কেন, বৃহত্তর জনগণের সঙ্গে তার কোনো নাড়ির বন্ধন নেই।তার বয়স যখন প্রায় ৩০ তখন থেকেই তাকে দেখি ব্রিটিশ রাজত্বের বিভিন্ন ত্রুটি, হৃদয়হীনতা ও অমানবিকতা সম্পর্কে তিনি  তীব্রভাবে সমালোচনামুখর।[5]

রবীন্দ্রনাথ স্বদেশকে শুধুমাত্র একটি ভূখণ্ডে আবদ্ধ না রেখে বিশ্বচেতনায় দেখেছেন। তিনি সবদিক থেকে দেশকে পরিপূর্ণ দেখতে চেয়েছিলেন। তাই তো তাঁর শান্তিনিকেতন, শ্রীনিকেতন ও জমিদারিতে পল্লী উন্নয়নের নানা কাজ করেছেন। আধুনিক কৃষিবিদ্যা, গোপালন, মাছ চাষ, হাতের কাজ, গ্রাম পঞ্চায়েতের সার্বিক ভাবনা, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ, গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন, পল্লীর স্বাস্থ্য চিকিৎসা,  খাদ্যাভাব মোচন, পরিবেশ ও স্থাপত্যবিদ্যা, শিশু ও নারীশিক্ষা, নানা কারিগরী শিক্ষা প্রভৃতির মাধ্যমে এক বিরাট কর্মযজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন, পরাধীন ভারতে এমন উদাহরণ বিরল।স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি তাঁর ছিল গভীর শ্রদ্ধা। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদের তাঁর নাইট উপাধি ত্যাগ, বঙ্গ ভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় তাঁর স্বদেশপ্রেমের গান আপামর ভারতবাসীর হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করেছিল।তাঁর আত্মনির্ভর ভারত সবধরণের সঙ্কীর্ণতার কলুষতা ও কালিমার শত শত আলোকবর্ষ দূরে ছিল।

রবীন্দ্রনাথের অখণ্ড ভারতীয়তাবোধের অজস্র ছবির মধ্যে এক উজ্জ্বল ছবি আমরা পাই তাঁর ‘গোরা’  উপন্যাসে। আমরা দেখি নিজেকে ‘ভারতীয় হিন্দু’ মনে করে যখন সে ধীরে ধীরে নিজেকে সনাতনী কুসংস্কারের বেষ্টনীতে আবদ্ধ করছিল, ঠিক তখনই সে জানতে পারে যে সে জন্মগতভাবে হিন্দু নয়, ‘মিউটিনি’র সমকালীন এক পরিত্যক্ত শিশু, তার বাবা একজন আইরিশ। এরপর গোরা সাময়িক বিভ্রান্তির ধূলিঝড় এড়িয়ে পরেশবাবুকে বলে, “…আমি দিনরাত্রি যা হতে চাচ্ছিলুম অথচ হতে পারছিলুম না, আজ আমি তাই হয়েছি। আমি আজ ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু-মুসলমান খ্রিস্টান কোনো সমাজের কোনো বিরোধ নেই। আজ এই ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন,…”। অবশেষে পরেশবাবুকে সে আরও বলে, “আজ সেই দেবতারই মন্ত্র দিন, যিনি হিন্দু-মুসলমান খ্রিস্টান ব্রাহ্ম সকলেরি—যার মন্দিরের দ্বার কোনো জাতির কাছে, কোনো ব্যক্তির কাছে কোনোদিন অবরুদ্ধ হয় না—যিনি কেবল হিন্দুর দেবতা নন, যিনি ভারতবর্ষের দেবতা।” এই হল রবীন্দ্রনাথের অখণ্ড ভারতবর্ষীয় সত্তার মূর্ত প্রতিচ্ছবি।

প্রসঙ্গত স্মরণীয় তাঁর সেই কবিতাটি-

এসো হে আর্য, এসো অনার্য,
হিন্দু-মুসলমান,
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ
এসো এসো খ্রিস্টান!
এসো ব্রাহ্মণ, শুচি কর মন
ধরো হাত সবাকার,
এসো হে পতিত, হোক অপনীত
সব অপমানভার।
মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা,
মঙ্গলঘট হয়নি যে ভরা
সবার পরশে পবিত্র করা
তীর্থ নীরে,
আজি ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে!

সর্বপ্রকার সংকীর্ণ স্বাদেশিকতা বা উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে তাঁর এই সোচ্চার ঘোষণা। খ্যাত-অখ্যাত রবীন্দ্র গবেষকরা প্রত্যেকেই স্বীকার করেন যে কবি ছিলেন বিশ্বপ্রেমিক। তাঁর স্বদেশপ্রেম বিদেশপ্রেমের পরিপন্থী ছিল না। স্বদেশের বা স্বজাতির সবকিছুই ভালো, আর বিদেশের বা বিদেশীর সব কিছুই মন্দ—এমন সংকীর্ণতা কখনই কবিকে পেয়ে বসে নি।

আর তাঁর স্বদেশ, আমাদেরও স্বদেশ—এই উপমহাদেশকে আজ আমরা কি চেহারায় দেখছি? অখণ্ড বাংলা ও অখণ্ড ভারতকে ঘিরে রবীন্দ্রনাথ যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁর মননে, তাঁর দর্শনে—তাঁর মহাপ্রয়াণের অর্ধ-শতাব্দীরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও সেই স্বদেশভূমি আজ যাবতীয় সংকীর্ণতা-বিভেদ-বিদ্বেষ ও রাষ্ট্রিক কলুষতায় আক্রান্ত। এই মহামনীষীর অযোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে আত্মাধিক্কৃত কণ্ঠে আমাদের বলা উচিত “এ আমার পাপ, এ তোমার পাপ।’ বর্তমান জাতীয় জীবনের ঘনঘোর সংকটের মুহূর্তে তাঁর স্বদেশপ্রেম, তাঁর মহত্তম জীবনদর্শনই হয়ে উঠতে একমাত্র ‘মুক্তির দিশা’—একথা সম্ভবত নতুন করে বলা নিষ্প্রয়োজন। আর ‘জ্ঞানপাপী’ হয়ে আত্মসমালোচনা তথা আত্মসংশোধনের পথে না গিয়ে সহস্র উপচার নিয়ে তাঁকে বন্দনা করলে, তাঁর ভাষাতেই অপ্রিয় বাস্তব অবস্থাটির প্রকৃত অর্থ হয়ে দাঁড়াবে, ‘তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলে থাকি।’[6]

কেন এমন হল? অনেক উত্তরের মধ্যে একটি উত্তর ডঃ অরবিন্দ পোদ্দার দিচ্ছেন এইভাবে-ভারতীয় সমাজমানসে জাতীয়তার বোধ পূর্বাপর দুর্বল ছিল; জন্ম থেকেই যেন তা পঙ্গু। এবং দুর্বল বলেই রাষ্ট্রীয় অভ্যুদয়ের শুভলগ্নে ভারত যেন একথাটি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হল যে, মানুষের সুপ্ত শক্তিকে মুক্তিদান করার কর্মই সর্বাপেক্ষা গৌরবময় কর্ম; ভুলে গেল যে, যে-দেশে প্রত্যেক মানুষের মুল্য  স্বীকৃত সে-দেশে সমস্ত জাতি সমস্ত সম্প্রদায় আপনিই বড় হয়ে উঠে। কোনো গণ্ডী বা সংকীর্ণ সীমার মধ্যে নয়, কারও ন্যায়সঙ্গত দাবী অস্বীকার করা বা কারও অসঙ্গত দাবীকে অকারণ স্নেহের প্রশ্রয়ে স্বীকার করার মধ্যে নয়, উদ্দেশ্যের সমতায়, আদর্শের মহানুভবতায় এবং জাতীয় সংহতির সার্বিক চেতনার মধ্যে মানুষের শক্তিকে উদ্বোধিত করাই প্রকৃত জেগে ওঠা। সেই পথই প্রকৃত সৃষ্টির পথ।কাউকে চোখ রাঙিয়ে ছোট করে রাখা সহজ হতে পারে, কিন্তু ঐ সহজ কর্মটাই অনেক সময় গভীর দুঃখের কারণ হয়।[7]

Tagore underlined: “To feel unity in diversity, to establish unity amidst variety—this the underlying religion of India. India does not regard difference as hostility, she does not regard the other as enemy. That is why without sacrifice or destruction she wants to accommodate everybody within the great system. That is why she accepts all ways and sees the greatness of each in his own sphere.[8]  আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথের ছবি ড্রয়িংরুমে টাঙিয়ে, বা তার দুটি কবিতা, গান তার জন্মদিনে ও মৃত্যুদিনে পাড়ার ক্লাবে আউড়ে বা তার দু এক খণ্ড রচনাবলী বইয়ের তাকে রেখে আমরা কবিকে অপমান না করলেও তার বিপুল বহুমুখি মানবসম্পদ উন্নয়নের অবদানের কথা অস্বীকার করতে পাক্কাদস্তুর সমর্থ হয়েছি। বাঙালির প্রতিদিনের জীবন এখন জাঙ্গলিক। তারা বেমালুম ভুলে গেছে যে রবীন্দ্রনাথ, সুভাষের চিন্তার ফল্গুধারায় তাদের আকাশ, বাতাস, মাটি সম্পৃক্ত। গান্ধীর হত্যাকারীরা কখনো তাদের নেতা হতে পারে না আর তাদের কাছ থেকে বাঙালিকে আর যাহোক দেশভক্তির পাঠ নিতে হবে না।এই বিশ্বাস বাঙালিরা আজ হারিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ ঠিক এই বেলাইনদের লাইনে আনতেই। দেশকে ভালবাসতে হলে ভালবাসুন যেমন করে রবীন্দ্রনাথ বাসতেন—ন্যায় ও সত্যের আমরণ পুজো করে। ভারত ভূখণ্ডকে শুধুমাত্র মাতা বা পিতা সম্বোধনে নয়।

[1] সমর সেন, বাবুবৃত্তান্ত ও প্রাসঙ্গিক, কলকাতাঃ দেজ, চতুর্থ পরিবর্ধিত সংস্করণ, বৈশাখ ১৪১১, পৃষ্ঠা ২২৭।print.

[2] Amartya Sen, “Tagore and his India” in The Argumentative Indian, London: Penguin Books, 2005, p. 108. Print.

[3] Rabindranath Tagore, Nationalism, Fingerprint Edition, 2020, p. 95. Print.

[4] নীরদচন্দ্র চৌধুরী, আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ, অখণ্ড সংস্করণ, কলকাতাঃ মিত্র ও ঘোষ, ১৪২১, পৃষ্ঠা ১০১।print.

[5] হায়াৎ মামুদ, রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তা, কালের খেয়া, ০৪ মে, ২০১৮।print.

[6] ভব রায়, ‘রবীন্দ্রভাবনায় অখণ্ড বাংলা ও অখণ্ড ভারতবর্ষ’, পশ্চিমবঙ্গ, রবীন্দ্র সংখ্যা ১৪০৫।print.

[7] ডঃ অরবিন্দ পোদ্দার, ‘রবীন্দ্রনাথের ভারতচিন্তা’ পুরশ্রী (সার্ধ শতবর্ষ বিশেষ সংকলন), ২০মে ২০১১, কলকাতা, ৫ম সংখ্যা।print.

[8] https://theprint.in/india/why-bengal-needs-to-learn-from-tagores-words-on-resolving-conflicts-though-hindu-viewpoint/653843/

Facebook Comments
- Advertisement -spot_img

More articles

- Advertisement -spot_img

Latest article